বাগদাদের পতন, খলীফা আবু আহমাদ আব্দুল্লাহ আল মুস্তাছিম বিল্লাহ ও হালাকু খান

চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান ১২৫৬ সালের জানুয়ারিতে বাগদাদ অবরোধ করে। তৎকালীন বাগদাদের খলীফা ছিলেন আবু আহমাদ আব্দুল্লাহ আল-মুস্তাছিম বিল্লাহ। তিনি পিতা ও তার পিতামহের মতো ধার্মিক এবং কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী ছিলেন; তবে, তাঁদের মতো দৃঢ় প্রত্যয়ী ও সচেতন ছিলেন না। বাগদাদ অভিযানে হালাকুর সঙ্গী হন মূছেলের শিয়া শাসক বদরুদ্দীন লুলু ও শিয়া পণ্ডিত নাছীরুদ্দীন তূসী। মহিউদ্দীন ইবনুল খোয়ারিযমী খাদ্য, বাহন ও অর্থ প্রেরণ করেন। মূছেলের শিয়া রাজপুত্র ছালেহও হালাকুর সঙ্গে যোগ দেন। সব মিলে দু’লক্ষ সৈন্য সাথে নিয়ে হালাকু বাগদাদের পথে রওয়ানা হন।
.
হালাকুর সৈন্যদল পূর্ব ও পশ্চিম- উভয় দিক থেকে বাগদাদের পথে রওয়ানা হয়। বাজুয়ানের নেতৃত্বে আরেক দল সৈন্য তিকরিতের পথ ধরে অগ্রসর হয়। ভয়ে লোকেরা বসত ভিটা ত্যাগ করতে শুরু করে। তারা নিরুপায় হয়ে নদী পাড়ি দেওয়ার সময় মাঝিরা ভাড়া হিসাবে স্বর্ণের চুড়ি, বালা ও বহু দীনার লাভ করছিল।
.
হালাকুর ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য দুজাইল নগরীতে প্রবেশ করলে খলীফার পক্ষ থেকে মুজাহিদুদ্দীন আইবক ইযযুদ্দীন সামনে অগ্রসর হন। তিনি অল্প সৈন্য নিয়েও বিশাল বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। কিন্তু চতুর তাতার সৈন্যরা রাতে দজলা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে দিলে মুসলিম সৈন্যরা দিশাহারা হয়ে পড়ে।
.
এই সুযোগে তাতার সৈন্যরা মুসলিম সৈন্যদের হত্যা ও বন্দি করতে সক্ষম হয়। কেবল তারাই রক্ষা পায় যারা নদীতে ঝাঁপ দেয় বা মরুভূমি হয়ে সিরিয়ায় পলায়ন করে। সেনাপতি ইযযুদ্দীন পালিয়ে বাগদাদে চলে যান। হালাকুর সৈন্যরা শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবেশ করে মুহাযিত-তাজের সামনে অবস্থান নেয়।
.
তাতার বাহিনী ৬৫৬ হিজরী ৪ঠা মুহাররম বাগদাদের প্রধান ফটকে অবস্থান নেয়। খলীফার সৈন্যরা ১৯শে মুহাররম পর্যন্ত প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। এরপর তাতাররা বাগদাদের প্রাচীর ভেঙ্গে শহরে প্রবেশ করে। এতে নাগরিকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। লোকেরা ভয়ে বহুতল ভবন ও উঁচু মিনারে আশ্রয় গ্রহণ করে।
.
হালাকু খান খলীফাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। খলীফা রাজী না হলে তাতাররা বাগদাদ নগরী অবরোধ করে। নিরুপায় খলীফা যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য শারফুদ্দীন ইবনুল জাওযীকে হালাকুর নিকটে পাঠান। প্রাথমিক আলাপের পর হালাকু সম্মত হয় যে, অর্ধেক কর হালাকুর জন্য হবে ও অর্ধেক হবে খলীফার জন্য।
.
খলীফা মুস্তা‘ছিম বিল্লাহ তিন হাজার অনুচর নিয়ে হালাকু খানের নিকট যান। এই দল যখন হালাকুর বাসস্থানের কাছে পৌঁছে তখন সতের জন ব্যক্তি ব্যতীত সকলকে হত্যা করা হয়। খলীফা হালাকুর নিকটে পৌঁছলে সে খলীফাকে বলল, আপনি মেযবান আর আমরা মেহমান। অতএব আপনি আমাদের উপযুক্ত মেহেনদারী করুন।
.
খলীফা তার ধনভাণ্ডারের তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এতে তার জন্য ত্রিশ হাযার পোশাক, দশ হাযার দীনার এবং অগণিত রত্ন হালাকুর সামনে উপস্থাপন করা হলো। হালাকু কোন ভ্রূক্ষেপ না করে বললেন, এগুলো আমার দাস ও সৈন্যদের জন্য। এগুলোতো প্রকাশ্য সম্পদ। কিন্তু গচ্ছিত ও রক্ষিত সম্পদ কোথায়?
.
খলীফা গুপ্ত সম্পদের কথা বলে দিলে তারা তা খনন করে বের করল। হালাকু খান স্বয়ং খলীফার সাথে অত্যান্ত অপমান সূচক আচরণ করলেন। খলীফা লাঞ্ছিত, ভীত ও অপদস্ত অবস্থায় বাগদাদে ফিরে এলেন। খাজা নাছীরুদ্দীন তূসী ও খলীফার প্রধান মন্ত্রী ইবনুল আলকামীও খলীফার সাথে বাগদাদে ফিরে এলো।
.
খলীফা মুস্তা‘ছিমের শত অনুনয়-বিনয় ও অনুরোধ সত্ত্বেও হালাকু খানের সাথে চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। হালাকু খলীফার সাথে সন্ধি করতে চাইলে ইবনুল আলকামী তাকে বলে, আপনি খলীফার সাথে চুক্তি করবেন না। কারণ তিনি এক বা দু’বছরের মধ্যে চুক্তি ভঙ্গ করবেন। তিনি আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন।
.
তারপর হালাকু খান খলীফাকে নির্দেশ দিলেন, বাগদাদবাসীকে বলেন যে তারা অস্ত্র ত্যাগ করে বাগদাদের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। খলীফা তাই করলেন। লোকেরা অস্ত্র ফেলে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। এসময় নিরস্ত্র লোকদের হত্যা করার জন্য সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড শেষ হলে হালাকু বাগদাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
.
এরপর খলীফা ও তার আত্মীয়-পরিজনকে হত্যা করা হয়। বাগদাদের অগণিত নারী-পুরুষের করুণ আর্তিকে উপেক্ষা করে মোঙ্গলবাহিনী বিভৎস হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। শুধু জীবননাশের মধ্য দিয়েই মোঙ্গলবাহিনীর অত্যাচার শেষ হয়নি, তাদের হাতে যুগ যুগ লালিত মুসলিম সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতিরও বিলুপ্তি ঘটে।
.
মুসলিম জাতির গৌরবকীর্তি, মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র বাগদাদ নগরী ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। এভাবে আরব্য রজনীর স্বপ্নপুরী বাগদাদ তার সর্বস্ব হারায়। চল্লিশ দিন ধরে হালাকু বাহিনী তাদের ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখে। তাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড হতে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ ও যুবক কেউ রেহাই পায়নি।
.
তাতারদের ৪০ দিনের ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় দু্’লাখ লোক নিহত হয়। এই সংখ্যা সলিল সমাধিতে মৃত ও নিখোঁজদের ব্যতীত। ঐতিহাসিক ব্রাউন বলেন, “সম্ভবত কখনো এত বড় ও সমৃদ্ধ একটি সভ্যতা এত দ্রুত বিধ্বস্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়নি”। ইবনে আলকামীর বাড়িতে আশ্রিত কিছু ব্যবসায়ী অর্থের বিনিময়ে রক্ষা পেয়েছিল।
.
খলীফার সাথে হালাকু খানের ইরাকের অর্ধেক রাজ্য প্রদানের শর্তে চুক্তি প্রায় হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় ইবনে আলকামী হালাকুকে বলল, বরং তাঁকে হত্যা করার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। অন্যথা পুরো ইরাক আপনার করতলগত হবে না। তাতাররা খলীফাকে বস্তায় ভরে আঘাত করতে করতে হত্যা করে।
.
বস্তায় ভরে হত্যার কারণ হলো- রক্ত যেন মাটিতে না পড়ে। কেননা, তারা জানত যে, রক্ত মাটিতে পড়লে তাদের উপর গযব নাযিল হতে পারে। কারণ, তিনি রাসূল (সাঃ) এর বংশধর এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর খলীফা। নাছীরুদ্দীন তূসী বুদ্ধি দিল- তাঁকে এমনভাবে হত্যা করা হোক যাতে রক্ত প্রবাহিত না হয়।
.
এরবলের শাসক ইবনু ছালায়া হালাকুকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিল তাকেও হালাকু হত্যা করে। মাসের পর মাস মসজিদসমূহ বন্ধ থাকে। এরই মধ্যে ইবনে আলকামী বাগদাদের শিয়াদের দর্শনীয় স্মৃতিজড়িত স্থানগুলো উন্মুক্ত করে দেয়। সে রাফেযী মতাদর্শ প্রচার ও প্রসার উদ্যোত হয়েছিল। কিন্তু ৪ মাস পরেই তার মৃত্যু ঘটে।
.
বাগদাদ পতনের কারণ :
১. শিয়া- সুন্নী দ্বন্দ্বঃ ইতিহাস নিন্দিত এ ঘটনার জন্য মূল দায়ী ব্যক্তি ছিল খলীফার প্রধানমন্ত্রী রাফেযী শীয়া ইবনু আলকামী। সে সর্বাস্থায় সুন্নীদের পতন কামনা করত। খলীফা মুস্তানসিরের আমলে যেখানে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি ছিল, সেখানে ইবনুল আলকামী সৈন্যের সংখ্যা কমাতে কমাতে দশ হাজারে নামিয়ে আনে।
.
অতপর মুসলিমদের দুর্বলতার সার্বিক বিষয়ে গোপনে পত্র লিখে পাঠায় হালাকু খানের কাছে এবং তাকে বাগদাদ আক্রমণের জন্য আহবান জানায়। ইরবিলের আমীর ইবনু ছালায়াকেও সে এ মর্মে পত্র লিখে পাঠান যে, তিনি যেন হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করেন এবং তাকে বাগদাদ আক্রমণে সহায়তা করেন।
.
ইবনে আলকামী নিজেকে বাগদাদের নায়েব বানানোর ওয়াদা লাভ করে অবশেষে হালাকুর নিকট গিয়ে বাগদাদ আক্রমণের আহবান জানায়। যুদ্ধে খলীফার পরাজয়ের পর ইবনে আলকামীকে হালাকুর সাথে চুক্তি করতে পাঠালে সে ফিরে এসে খলীফাকে জানায় যে, হালাকু আপনার ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিতে চান।
.
সে বিয়ের পয়গাম নিয়ে মন্ত্রী পরিষদসহ খলীফাকে হালাকুর দরবারে যেতে প্ররোচিত করে। ফলে খলীফা মন্ত্রী, আত্মীয় ও আলেম-ওলামাকে সাথে নিয়ে ছেলের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য হালাকু খানের নিকট গমন করেন। এ সুযোগে হালাকু খানের সৈন্যরা খলীফা ও তার সতের জন সঙ্গী ব্যতীত সকলকে হত্যা করে।
.
ইবনে আলকামী ও নাছীরুদ্দীন তুসী এই দুই শিয়া মন্ত্রী বাগদাদ ধ্বংসের যাবতীয় পরিকল্পনা সম্পন্ন করে। এরা তাতারদের বাগদাদে ডেকে আনে। তাতাররা বাগদাদ নগরীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর শিয়া-সুন্নী সকলকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ইবনুল আলকামীকে বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য স্বয়ং হালাকু খান তিরস্কার করেছিল।
.
হালাকু চূড়ান্তভাবে বাগদাদের নিকটবর্তী হলে ইবনে আলকামী খলীফাকে পরামর্শ দিল যে, “ধন-সম্পদ খরচ করে তা প্রতিহত করুন। এক হাজার বাহনে মূল্যবান সামগ্রী, এক হাজার মূল্যবান উট, এক হাজার আরবীয় ঘোড়া, অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রী পাঠিয়ে দেওয়া এবং নিজেদের ওযর পেশ করা হোক”।
.
২. মাযহাবী দ্বন্দ্বঃ বাগদাদ আক্রমণের অপর উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের দ্বন্দ্ব। ৪৬২ হিজরীতে ইবনুস সাম‘আনী হানাফী মাযহাব ত্যাগ করে শাফেঈ মাযহাব অবলম্বন করলে এই দু’মাযহাবের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এতে খোরাসান ও মারভ নগরী শ্মশানে পরিণত হয়।
.
হানাফী ও শাফেঈদের পারস্পারিক মারামারি করার শারীরিক ক্ষমতা যেন লোপ না পায় এজন্য উভয় মাযহাবের লোকেরা নিজ নিজ আলেমদের ফতোয়া অনুসারে রামযান মাসে সিয়াম পালন থেকে বিরত থাকত। নিয়মিত কোন না কোনো স্থানে বাহাসের আয়োজন হতো এবং বাহাসের একটা পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী বিবাদ হতো।
.
তূস শহরে হানাফী মাযহাবের লোকেরা হালাকু বাহিনীকে শাফেঈদের হত্যা করার জন্য আহবান করে এবং নিজেরাই হালাকু বাহিনীর জন্য শহরের দরজা খুলে দেয়। অতঃপর তাতাররা শহরে প্রবেশ করে এবং হানাফী-শাফেঈ নির্বিচারে হত্যা করে।
.
রেফারেন্স- ১] শিয়া ইমাম নাছীরুদ্দীন তূসী তাতারদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। কিন্তু তাদের আলমূত দুর্গের পতন হলে তিনি হালাকুর সঙ্গী হন। তারই পরামর্শে খলীফাকে বস্তায় ভরে হত্যা করা হয় এবং বাগদাদের আলেম, ফক্বীহ ও বিচারকদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয় (শাযারাতুয যাহাব ৫/৩৪০; আল-বিদায়াহ ১৩/২০১)।
২] মূল আলেখ্য আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত হয়েছে।
৩] Lane-pool, The Muhammadan Dynasties, পৃষ্ঠা- ২০৬।
৪] রশীদুদ্দীন, জামি‘উত তাওয়ারীখ ২/১/২৬৮; তারীখুল ইসলাম ৪/১৪৭।
৫] ড. হাসান ইবরাহীম হাসান, তারীখুল ইসলাম ৪/১৪০।
৬] আল্লামা সুয়ূতী, তারীখুল খোলাফা ১/৩২৮, ৪০১।
৭] ইবনু আবীল হাদীদ, শারহু নাহজিল বালাগাহ ২/৪৯৩, ৮/২৩৭।
৮] ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত-তারীখ ১০/৩৪১।
৯] তারীখে ইবনে খালদূন ৫/৫৪২।
১০] ইবনুল আমীদ, শাযারাতুয যাহাব ৫/২৭০।
১১] সুবকী, তাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৬২।
১২] আব্দুল হাই, শাযারাতুয যাহাব ৫/২৭০।
১৩] যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১৬/৩৮৩।
১৪] তাবাকাতে শাফেঈয়া ৮/২৬২।
১৫] ইয়াফেঈ, মির’আতুল জিনান ৪/১০৫।
১৬] যাহাবী, দুওয়ালুল ইসলাম ১/১৮৬।
১৭] তাফসীরে মানার ৩/১০।
১৮] রশীদ রেযা, তাফসীরে মানার ৩/১০।
১৯] ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/২৫৪ ও আল-ফাতাওয়াল কুবরা ২/১০৯।
২০] শা‘রানী, কিতাবুল মীযান ১/৪৩।
.
Mohammad Salimullah মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *